সিলেটের দফায় দফায় ভূকম্পন নিয়ে চিন্তিত বিশেষজ্ঞরা। এ ধরনের ভূমিকম্প কীসের আলামত- এ নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। তাদের মতে- নিকট অতীতেও এ ধরনের ঘন ঘন ভূমিকম্পের কোনো তথ্য নেই। ঘন ঘন ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের বার্তা দিয়ে যায় বলে জানিয়েছেন তারা। কারণ- সিলেট কিংবা আসাম ও মেঘালয় অঞ্চলে একশ’ বছরের মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি। এ কারণে তারা আগামী এক সপ্তাহ সিলেটের মানুষকে সাবধান ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞ ও ভূ-তাত্ত্বিক গবেষকদের এমন বার্তায় সিলেটের মানুষের মধ্যে কিছুটা ভীতিও কাজ করছে। সিলেট এখন বহুতল ভবনের শহর।
প্রতিযোগিতা করে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। দফায় দফায় ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয়েছেন এসব ভবনে বসবাসকারীরা। এ কারণে শনিবার যখন চার ঘণ্টার ব্যবধানে ৫ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয় তখন বিকালের দিকে অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে নগর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। সু-উচ্চ ভবনের মধ্যে একটি হচ্ছে গার্ডেন টাওয়ার। এই টাওয়ারে বসবাসকারী কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন- বড় ধরনের ভূমিকম্পের বার্তায় টাওয়ারে থাকা কয়েকটি পরিবার গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। আতঙ্ক কেটে গেলে তারা ফিরে আসবেন বলেও জানিয়ে গেছেন। শুধু গার্ডেন টাওয়ারই নয়, নগরীর তেলিহাওরের সু-উচ্চ টাওয়ার, সুবিদবাজারের মার্লিন টাওয়ারসহ কয়েকটি টাওয়ারে বসবাসকারী অনেক পরিবার তাদের পোষ্যদের নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। গতকাল রোববারও কয়েকটি পরিবার শহর ছেড়েছেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. জহির বিন আলম গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ‘ঘন ঘন ভূমিকম্প কীসের আলামত সেটি বুঝা যাচ্ছে না। তবে সাধারণত ঘন ঘন ভূমিকম্প একটি বড় ভূমিকম্পের বার্তা দেয়। এ কারণে আমরা আপাতত এক সপ্তাহ সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছি। সিলেটে স্থানীয়ভাবে উৎপত্তি হওয়া এসব ভূ-কম্পন যদি সত্যি সত্যি ভূমিকম্প হয় তাহলে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি থেকেই যায়। এটি যে সিলেটে হতে পারে তা নয়, ভারত কিংবা সিলেটের আশপাশ এলাকাগুলোতেও হতে পারে।’ ড. জহির জানান, ‘স্থানীয়ভাবে উৎপত্তি হওয়া এই ভূমিকম্প নিয়ে এখনো ভূ-তাত্ত্বিকরা কোনো উপসংহারে পৌঁছতে পারছেন না। একটি ধারণা আছে; মেঘালয়ে পাথরের পাহাড় ধ্বংস করতে বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়। এর ফলে এটি হচ্ছে কিনা- তা খতিয়ে দেখতে হবে। অথবা অন্যকোনো কারণে হতে পারে। এত ঘন ঘন ভূ-কম্পনের নজির সাম্প্রতিক কালে কোথাও নেই। আরো কিছু সময় গেলে হয়তো এই ভূমিকম্প সম্পর্কে সবটা জানা সম্ভব হবে।’ শনিবারের ভূমিকম্প নিয়ে যখন সিলেটজুড়ে তীব্র আতঙ্ক তখন রোববার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে আবারো মৃদু ভূকম্পন হয় সিলেটে। ঘুমে আচ্ছন্ন সিলেটবাসীর মধ্যে এই ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। অনেকেই ভোরে বহুতল ভবন ছেড়ে রাস্তায় চলে আসেন। সিলেটের আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রধান কর্মকর্তা সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন, এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলও সিলেটে। এটির মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ২ দশমিক ৮। এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। আবহাওয়া অফিসে এ নিয়ে ৫ম বারের মতো ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। এর বাইরে ভূমিকম্প হলে সেটি রেকর্ড হয়নি। একটি নির্ধারিত মাত্রার নিচে ভূমিকম্প রেকর্ডও হয় না বলে জানান তিনি। সিলেটের পাশেই ভূমিকম্পের ডাউকী ফল্ট। এটি ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন। শনিবার জৈন্তাপুরে যে ভূমিকম্প হয়েছে সেটি ডাউকী ফল্টের একেবারে নিকটবর্তী এলাকা। ডাউকী ফল্টের বিস্তৃত মেঘালয়, আসাম, নেপাল, সিলেট। ফলে ছোটো ছোটো ভূমিকম্পের কারণে ঝুঁকিতে থাকা ডাউকী ফল্ট নিয়ে চিন্তা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ভূ-তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা। তারা জানিয়েছেন, একটি ভূমিকম্পের পর আরেকটি আফটার শক হয়। কিন্তু দফায় দফায় ভূমিকম্প কেন হচ্ছে- সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। এ নিয়ে সিলেটের শাবিপ্রবি’র বিশেষজ্ঞরা বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা খুঁজছেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের ডিন প্রফেসর ড. মোস্তাক আহমদ জানিয়েছেন, ডাউকী ফল্ট প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রশস্ত এটি ৫ কিলোমিটার। ডাউকী ফল্টের কোনো শাখা- প্রশাখার কারণে এই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। একটি ভূমিকম্প জোনের অনেকগুলো শাখা- প্রশাখা থাকে বলে জানান তিনি। এদিকে ভূমিকম্প নিয়ে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ইতিমধ্যে মনিটরিং সেল, কন্ট্রোল রুম খোলার পাশাপাশি রোববার বিকাল থেকে অভিযানে নেমেছেন। প্রাথমিকভাবে ২৪টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে আগামী ১০ দিনের মধ্যে এগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন। এ সময় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, ভূতত্ত্ববিদরা আশঙ্কা করছেন আগামী এক সপ্তাহ বা ১০ দিনের মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। তাদের এই পরামর্শ বিবেচনায় নিয়ে ২৪টি মার্কেট ও ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো রোববার থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে তিনি ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেই এটি করেছেন। এখানে সরকারি ভবনও রয়েছে। সেগুলোর কার্যক্রমও বন্ধ থাকবে। বিকালে মেয়র নগরীর সিটি সুপার মার্কেট, মিতালী ম্যানশন, প্লাজা ম্যানশন ও মধুবন সুপার মার্কেট সহ কয়েকটি মার্কেটে মেয়র নিজেই গিয়ে মার্কেট বন্ধের ঘোষণা দেন। ঝুঁকিপূর্ণ এই ভবনগুলোর মধ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের উত্তর পাশের কালেক্টরেট ভবন-৩, জেল রোডস্থ সমবায় ব্যাংক ভবন, একই এলাকায় মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার সাবেক কার্যালয় ভবন, সুরমা মার্কেট, বন্দরবাজারস্থ সিটি সুপার মার্কেট, জিন্দাবাজারের মিতালী ম্যানশন, দরগা গেইটের হোটেল আজমীর, বন্দরবাজারের মধুবন সুপার মার্কেট, টিলাগড় কালাশীলের মান্নান ভিউ, শেখঘাট শুভেচ্ছা-২২৬ নম্বর ভবন, যতরপুরের নবপুষ্প ২৬-এ বাসা, চৌকিদেখির ৫১-৩ সরকার ভবন, জিন্দাবাজারের রাজা ম্যানশন সহ কয়েকটি মার্কেট ও ভবন রয়েছে। ভূমিকম্পে সিলেটের পাঠানটুলার দর্জিপাড়ায় একটি ছয়তলা ভবন হেলে পড়েছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। শনিবার রাতে মেয়র সহ পুলিশের কর্মকর্তারা গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন থেকে সবাইকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বিকালে ওই এলাকায় গিয়ে জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞরা নির্ধারণ করবেন ভবনগুলো ঠিক আছে কিনা। যদি ঠিক থাকে তাহলে বাসিন্দারা বসবাস করতে পারবেন। ঝুঁকি কমাতে আপাতত বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মালিকের স্বজন আশিকুর রহমান জানিয়েছেন, ভবনটি মোটেও ঝুঁকিপূর্ণ নয়। এটি নির্মাণকালেই পাশের ভবনের মালিক একেবারে গা ঘেঁষে ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। সিটি করপোরেশনের ঘোষণার পর কেউ বাসা ছেড়ে চলে যায়নি বলে দাবি করেন তিনি।