বেলা দেড়টা বাজতেই দোকানের সামনে হাজির এক যুবক। হাত বাড়াতেই কোনো কথা না বলে দোকানি ধরিয়ে দেন ১০০ টাকা। এ দৃশ্য রাজধানীর ব্যস্ততম মতিঝিল শাপলা চত্বরের পাশের ফুটপাতের।
দোকানি জানালেন, যে লোকটি এসেছিলেন, তাঁর নাম শহীদ। তিনি ক্ষমতাসীন দলের কর্মী মকবুল হোসেনের লোক। এই ফুটপাতের সব চাঁদা মকবুল আদায় করেন। তবে তিনি মাঠে আসেন না। তাঁর হয়ে শহীদ, তাজু ও বাবুল আসেন। তাঁরা দোকানপ্রতি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আদায় করেন।
দোকানির সঙ্গে কথা বলার সময় পাশের দোকান থেকেও চাঁদা তুলছিলেন শহীদ। কিন্তু ক্যামেরা তাক করতেই দ্রুত সরে পড়েন। এরপর কথা বলতে চাইলেন না দোকানিরাও।
ফুটপাতে চাঁদাবাজির এ দৃশ্য প্রতিদিনের। এমন কোনো সড়ক নেই, যেখানে চাঁদা না দিয়ে কেউ ব্যবসা করতে পারেন।
রাজধানীর ফুটপাত যেন চাঁদারহাট। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত এক দিনেই ফুটপাতের প্রায় ৩ লাখ দোকান থেকে উঠছে ৬ কোটি টাকার চাঁদা। সেই হিসেবে মাসে ১৮০ কোটি এবং বছরে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি চলছে। দীর্ঘদিন ধরে এটা চলে আসছে। তবে এখন এটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। আগে টাকা পেত বিএনপির এক শ্রেণির নেতা। বর্তমানে আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির নেতা চাঁদাবাজিতে জড়িত। এক্ষেত্রে দুটি গ্রুপ কাজ করছে। একটি গ্রুপ ফুটপাতের অবৈধ দোকানগুলো থেকে ভাড়া আদায় করছে, আরেকটি গ্রুপ চাঁদার টাকা তুলছে। ‘লাইনম্যানদের’ মাধ্যমে তোলা এই চাঁদার টাকা যাচ্ছে স্থানীয় এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতাকর্মী, কিছু দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্য এবং ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা গডফাদারদের পকেটে। মূলত চাঁদার বড় অঙ্কটা পান গডফাদাররা।
অবৈধ এ টাকার জোরেই ফুটপাত কখনোই পুরোপুরি হকারমুক্ত হয় না। ফুটপাত দখলে নেওয়ায় রাজধানীর অনেক স্থানেই সংকুচিত মানুষের চলার পথ। বাড়ছে যানজট। কোথাও অবৈধ স্থাপনা, বিভিন্ন মালামাল রেখে দেওয়ায় বিড়ম্বনায় পড়েন পথচারীরা। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে পুলিশ ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দায়িত্ব ও ভূমিকা চান ঢাকার দুই মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুই নেতা।
২১ জন হকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইত্তেফাককে জানান, চাঁদার টাকা না দিলে দোকান রাখা অসম্ভব। লাইনম্যানরা টাকা তুলে নেয়। তারপর ভাগাভাগি হয়। তবে টাকার বড় অংশই চলে যায় গডফাদারদের পকেটে। থানা আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির নেতা এবং কিছু ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও তাদের ঘনিষ্ঠ নেতারা এই লাইনম্যান নিয়োগ দেন।
বেশির ভাগ হকারই টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন না। কারণ এ নিয়ে সংবাদ প্রচার হলে কয়েক দিন পুলিশের উত্পাতে দোকান বসানোই অসম্ভব হয়ে পড়বে। চাঁদার টাকা কম দিলে কিংবা কখনো ওপরের আদেশ এলে সারা দিনই এক শ্রেণির পুলিশ সদস্য ও হকারদের মধ্যে চলে ইঁদুর বিড়াল খেলা। অভিযোগের পর অভিযোগ আসার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে শতাধিক লাইনম্যানের নামে মামলা করা হয়েছে। কিন্তু এ আসামিদের কাউকেই খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। যদিও অভিযোগ রয়েছে এরা সবাই রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
রাজধানীর তোপখানা রোড। ঐ এলাকার ফুটপাতের প্রায় ৪০০ দোকান থেকে চাঁদা তোলেন এক হালিম বিক্রেতা। প্রতিদিন তিনি নিজের দোকান ছেড়ে একের পর এক দোকানে যাচ্ছেন আর চাঁদা নিচ্ছেন। বিক্রি কম হওয়ায় দোকানিরা কম টাকা দিলে শাসাতেও ছাড়ছেন না লাইনম্যানরা। বায়তুল মোকাররম, পল্টন ও মতিঝিল এলাকার প্রায় ৫ হাজার দোকানে টাকা তোলেন তিন জন লাইনম্যান। ফুটপাত তো বটেই, সড়ক দখল করে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানের সব সড়কেই চলছে হকারদের রমরমা ব্যবসা। সদরঘাট এলাকার ফুটপাতে আছে দুই শতাধিক দোকান। লক্ষ্মীবাজার এলাকায় দোকান আছে ১০০ মতো। ব্যবসা হোক আর না হোক, সব মিলিয়ে এখানকার একজন ব্যবসায়ীকে দিনে অন্তত ২০০ টাকা চাঁদা দিতেই হয়। নগরীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটে প্রতিদিন লাখো মানুষের পদচারণা। দিন-রাত সবসময়ই মানুষে ভরপুর থাকে ফুটপাত ও রাস্তাঘাট। বারবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না ফার্মগেট এলাকার ফুটপাত। ফুটপাতে ব্যবসা করতে হলে প্রত্যেক হকারকেই ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত এককালীন দিতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকায়, গুলিস্তান, নিউমার্কেট, ফার্মগেট, মিরপুর ১ ও ১০ নম্বরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বসার জন্য আগে থেকে মোটা অঙ্কের অফেরতযোগ্য টাকা দিয়ে বসতে হয়। জনগণের হাঁটার জায়গা ভাড়া দিয়ে দেয় স্থানীয় প্রভাবশালীদের একটি গোষ্ঠী। এসব বিষয়ে কিছু জানে না সিটি করপোরেশন। তারা বিভিন্ন সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। তারপরও দখলমুক্ত হচ্ছে না ফুটপাত। উচ্ছেদ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব কিছু আগের মতো হয়ে যায়। প্রভাবশালীদের চাঁদাবাজিতেই হকারদের কর্তৃত্ব বহাল থাকে বলে মনে করেন অনেকে।
বারবার উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পরও ফুটপাত মুক্ত রাখতে না পারার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করছেন নগর বিশ্লেষকরা। এদিকে এ দায় নিতে রাজি নয় সিটি করপোরেশন কিংবা মহানগর পুলিশ। সিটি করপোরেশেনের কর্মকর্তারা বলেন, উচ্ছেদের পর নজরদারি না থাকার কারণেই দখলমুক্ত থাকছে না ফুটপাত। আর জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল ভূমিকার ওপর জোর দিচ্ছে পুলিশ। পথচারীদের নির্বিঘ্নে চলাচলে ফুটপাত দখলমুক্ত রাখার হাইকোর্টের একাধিকবার আদেশ থাকলেও মানছে না কেউই।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রাজধানীর ফুটপাতের দোকানপাট আমরা সবসময় উঠিয়ে দেই। তবে হকাররা আবার বসে। ফুটপাতের দোকানগুলোতে চাঁদাবাজির সঙ্গে কারোর জড়িত থাকার অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, ফুটপাতকে দখলমুক্ত রাখা পুলিশের দায়িত্ব। কিন্তু সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা হয় না। তিনি বলেন, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলেন—এটা সঠিক নয়। তবে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে যাদের ওয়ার্ড কাউন্সিলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে তারা এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলদের নিজস্ব বলয়ের লোকদের হয়তো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ফুটপাত ক্লিন রাখতে সবাইকে কঠিন হতে হবে। এক্ষেত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পুলিশ ও দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। শেখ বজলুর রহমান বলেন, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আগামী ১১ জুন বর্ধিত সভার আয়োজন করা হয়েছে। এই সভায় সবাইকে একটা ম্যাসেজ দিয়ে দেব। সেটি হলো মহানগরের নেতাকর্মীদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে ফুটপাতে চাঁদাবাজি অভিযোগ ও যাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহাম্মদ মন্নাফি বলেন, পুলিশ বাহিনী রাজধানীর ফুটপাত দখলমুক্ত করে ফেললে তো ভালোই হয়। কেন ফুটপাত দখলমুক্ত হয় না, কারা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত তা আমরা জানি না। আমাদের কিছু করার নেই। চাঁদাবাজিতে কারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়ার উচিত।
হকার্স নেতাদের ভাষ্য: দীর্ঘদিন ধরেই হকারদের পুনর্বাসনের নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছে জাতীয় হকার্স ফেডারেশন। দাবির মধ্যে রয়েছে সরকারি কোষাগারে রাজস্ব প্রদানের সুযোগ, ফুটপাত মুক্ত করে খালি জায়গায় ব্যবসার সুযোগ, পূর্ণাঙ্গ জরিপ করে সব হকারকে পরিচয়পত্র প্রদান।
গত ৬ এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ফেডারেশনের পক্ষ থেকে এ নতুন প্রস্তাব দেওয়া হয়।