বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের করোনাভাইরাসজনিত দুর্যোগে সরকারি ত্রাণ তৎপরতায় ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে।
জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের বাইরে রেখে ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে সচিবদের দায়িত্ব দেওয়া নিয়েও কথা হয়েছে। অনেক সংসদ সদস্য বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন। এদিকে ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ না নেওয়ার কারণে অনেক সংসদ সদস্য যেমন সমালোচনার মুখে পড়ছেন, বিপরীতে সরকারি ত্রাণ বিতরণে তাদের অংশগ্রহণ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আইনসভার সদস্য হয়ে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বে ‘হস্তক্ষেপ’ উল্লেখ করে সংসদ সদস্যদের এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণের এখতিয়ার ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। আলোচনায় উঠে এসেছে তাদের দায়-দায়িত্ব প্রসঙ্গও।
সংবিধানসহ দেশের প্রচলিত আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সংসদ সদস্য হিসেবে তাদের আইনি দায়িত্বটাই হচ্ছে আইন প্রণয়ন করা। এর বাইরে তাদের যে দায়িত্ব রয়েছে সেটাও সংসদ সংশ্লিষ্ট। দেশের আইনজ্ঞদের অভিমতও এটাই। সংসদ সদস্যরাও আইন প্রণয়নকে তাদের প্রধান কাজ উল্লেখ করেছেন। তারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে তারা নির্বাহী বিভাগকে কেবল উপদেশ বা পরামর্শই দিতে পারেন। সরকারের যেকোনও ধরনের সিদ্ধান্ত বা কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের নয়, এই দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের।
বিশ্লেষকদের অভিযোগ, আইন প্রণয়ন বা সংসদ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সংসদ সদস্যদের প্রধান দায়িত্ব হলেও সেই কাজটিতেই তাদের দৃষ্টি কম। অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়নে তাদের ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না। যার কারণে মাত্র কয়েক মিনিটে বড় বড় আইন পাস হতে দেখা যায়।
সরকারের কাঠামোর দিক থেকে পর্যালোচনা করলে বলা যায়, আইন বিভাগের সদস্য হিসেবে সংসদ সদস্যদের নির্বাহী দায়িত্ব পালনের কোনও সুযোগ নেই। এই দায়িত্বটা কেবল নির্বাহী বিভাগেরই। অবশ্য সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা একইসঙ্গে আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সদস্য হওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে দ্বৈত ভূমিকার সুযোগ রয়েছে।
এদিকে, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী দুটি স্থানীয় সরকার প্রশাসনেই স্থানীয় সংসদ সদস্য উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের উন্নয়ন ও আইনশৃঙ্খলা কমিটিসহ মাঠ প্রশাসনের আরও কয়েকটি কমিটির উপদেষ্টা থাকেন তারা। টিআর, কাবিখা/কাবিটাসহ বিভিন্ন সামাজিক বেষ্টনীমূলক কর্মসূচিতেও তাদের পরামর্শ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এসব খাতে তারা বরাদ্দ পেতে জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দিতে পারেন। তবে, এসব খাতের ব্যয় নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংসদ সদস্যদের অনুকূলে এলাকার রাস্তাঘাট উন্নয়নে থোক বরাদ্দ দেওয়ার বিধান করলেও তা হয় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে কোন কোন রাস্তা মেরামত বা সংস্কার করতে চান তা উল্লেখ করে সংসদ সদস্যরা তার তালিকা দেন। পরে স্থানীয় প্রশাসন তা যাচাই-বাছাই করে বরাদ্দ দেন। এর আগে সংসদ সদস্যরা স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হলেও উচ্চ আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই সুযোগ সীমিত হয়েছে।
সংসদ সদস্যদের এসব কার্যক্রমের মধ্যে জেলা ও উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা নির্বাচনের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আইনের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। সংসদ সদস্যদের সংসদের বাইরে বাকি দায়িত্বগুলো দেওয়া হয় সরকারি আদেশের মাধ্যমে।
দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে বেশির ভাগ সংসদ সদস্যই আইন প্রণয়নের কথাই উল্লেখ করেন। তারা জানান, সংসদের বাইরের যেসব কাজে তাদের সম্পৃক্ততা আছে তার সবই স্বেচ্ছাধীন। মাঠ প্রশাসনে তাদের কার্যক্রমগুলো পরামর্শমূলক। তবে, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব তাদের রয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকে এসব কাজে তারা সম্পৃক্ত হন। এছাড়া সরকার থেকে মাঠপ্রশাসনের কার্যক্রম তদারকির নির্দেশনাও তাদের দেওয়া হয়।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘সংসদ সদস্য হিসেবে আইন প্রণয়নই আমাদের প্রধান কাজ। তবে, বাস্তবতা হচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ দায়িত্ব পালন করতে পারি না। এক্ষেত্রে সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের তো আরও সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের সংসদীয় ক্ষমতা আরও বাড়ানো দরকার। সংসদকে আরও কার্যকর করা দরকার।’
নির্বাচনি এলাকায় সরকারি কাজে সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের সমস্যা হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে ভোট করতে হচ্ছে আর কাজ করতে হচ্ছে সংসদে। তবে, আমরা অনেকে ভুলে যাই স্থানীয় পর্যায়ে আমাদের কাজ হচ্ছে উপদেষ্টার। অনেকে দেখা যায় হস্তক্ষেপ করতে চান, এটা উচিত নয়। উপদেষ্টা হিসেবে আমরা পরামর্শ দিতে পারি। আমাদের এক্সিকিউশনে রোল নেই। সুপারভিশনটা (নজরদারি) প্রশাসনের করাই ভালো বলে আমি মনে করি।’ ব্যক্তিগতভাবে উপদেষ্টা হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্বটাকে সমীচীন মনে করেন এই সংসদ সদস্য।
করোনাকালে সরকারি ত্রাণ বিতরণের সময় কয়েকজন সংসদ সদস্যের ডিও লেটারের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘ত্রাণ বিতরণে কমিটি রয়েছে। তারা কাজ করে। উপজেলা নির্বাহী অফিস তা তদারকি করে। আমরা চাইলে পরামর্শ দিতে পারি, তবে হস্তক্ষেপ উচিত নয়।’ স্থানীয় রাস্তাঘাটের উন্নয়নে থোক বরাদ্দসহ সংসদ সদস্যদের অনুকূলে যেসব বরাদ্দ যায় তার সবই স্থানীয় প্রশাসন বাস্তবায়ন করে বলে তিনি জানান।
বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদও সংসদ সদস্য হিসেবে তাদের দায়-দায়িত্বের বিষয়ে একই ধরনের মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্য হিসেবে আমাদের প্রধান কাজ হলো আইন প্রণয়ন করা এবং সংসদসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেওয়া। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সংসদ সদস্যদের কথায় এলাকার উন্নয়ন কাজগুলো হয়। নির্বাচনি এলাকায় আমাদের প্রস্তাবনাগুলোতে প্রাধান্য দেওয়া হয়। উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে আমাদের পরামর্শ দেওয়ার বিধান রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন কমিটিতে উপদেষ্টা হিসেবে আমাদের রাখা হয়েছে। উপদেশ যেটা দেবো সেটা গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা নেই। সরকারি দল হলে উপদেশ দিলে সেটা গ্রহণ হয়েই থাকে। বিরোধী দলের উপদেশ বেশির ভাগ সময় শোনা হয় না।’
তিনি জানান, সরকারি রিলিফ ও ত্রাণ বিতরণে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা একেবারেই গৌণ ও নগণ্য। নির্বাহী বিভাগ থেকে যেভাবে পরিপত্র জারি হয় সেভাবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাগুলো তা বিতরণ করে। কাজেই এখানে আলাদা কোনও তালিকা দিয়ে সংসদ সদস্যদের বিতরণের কোনও সুযোগ নেই। তবে, সমাজের অন্য দশ জনের মতো কোনও সংসদ সদস্য চাইলে ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করতে পারেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাঙ্গাইল জেলার একজন সংসদ সদস্য বলেন, ‘আমরা স্থানীয় বডিগুলোর উপদেষ্টা। আমাদের উপদেশ দেওয়ার মধ্যে দায়দায়িত্ব সীমাবদ্ধ থাকা উচিত বলে মনে করি। ত্রাণ বিতরণে দেখা গেছে, কিছু কিছু সংসদ সদস্য ডিও লেটার দিয়ে ত্রাণের কোটা চেয়েছেন। আমার মনে হয় না এটা ঠিক হয়েছে। একজন সংসদ সদস্য হয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ডিও লেটার দেওয়াটাকে আমার কাছে অপমানজনক মনে হয়।’
আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘সংবিধান আর আইনের কথা বলতে গেলে বলতে হবে, আমাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু আমাদের দেশে তো এটার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা যায় না। এলাকার উন্নয়নটা সংসদ সদস্যদের দেখতে হয়। মানুষ তা প্রত্যাশাও করেন। মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার যতগুলো বিষয় রয়েছে সবগুলোর সঙ্গেই সংসদ সদস্যদের সম্পৃক্ততা থাকে। আমি মনে করি, এটা সঙ্গত এবং স্বাভাবিক। কারণ নির্বাচনি এলাকার মানুষ ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছে, তার কাছে কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকবেই। সরকার এলাকার উন্নয়নে সংসদ সদস্যদের যখন যে দায়িত্ব দিয়ে থাকে সেটা পালন করতে হয়। দায়িত্ব না দিলেও জনগণের ভালোমন্দটা দেখবার বিষয় তাদের রয়েছে বলে আমি মনে করি এবং তারা তা করেন।’
ত্রাণ তদারকিতে সচিবদের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা এলাকার দেখভালে বেশি ব্যস্ত থাকার জন্য হয়তো সচিবদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর সচিবদের দায়িত্ব দেওয়া হলেও সংসদ সদস্যদের বাইরে গিয়ে কিছু করা হচ্ছে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করাই সংসদ সদস্যদের কাজ। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির আওতায় সংসদ সম্পর্কিত আরও কিছু দায়দায়িত্ব স্পষ্ট তাদের রয়েছে। এর বাইরে আইনিভাবে তাদের কোনও দায়দায়িত্ব নেই। তবে, সংসদ সদস্যদের সংসদের পরিবর্তে বাইরের দায়িত্ব পালনে বেশি আগ্রহ দেখা যায়। যার কারণে আমরা চার মিনিটে আইন পাস হওয়ার রেকর্ড দেখতে পাই।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের ত্রাণ তৎপরতা চালানো বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া সংসদ সদস্যদের কোনও নিয়মিত কাজ নয়। এই কাজগুলো করবে লোকাল বডির নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। এগুলো হয়তো সুপারভিশনের দায়িত্ব অনেক সময় সংসদ সদস্যদের দেওয়া হয়। কিন্তু সুপারভিশনটাই হস্তক্ষেপ হয়ে যায়।’
সংসদ সদস্যরা যাতে টিআর/কাবিখাসহ স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকেন সেজন্য ‘পিপলস ল ফোরাম’ থেকে তারা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন উল্লেখ করে জ্যোতির্ময় বলেন, ‘সংসদ সদস্যরা এলাকায় গিয়ে টিআর/কাবিখাসহ এ ধরনের কাজে অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এগুলো তাদের কাজ নয়। দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ হয় এর মাধ্যমে।’ এই কাজ থেকে বিরত রেখে সংসদের কাজে তাদের সীমাবদ্ধ থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।