এর বাইরে শক্ত যে যুক্তিটি আশুতোষ তুলে ধরেছেন, সেটি হলো রাজ্যে ক্ষমতায় থেকেও ‘ভিক্টিম কার্ড’ খেলে সাফল্য পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১. দুবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থেকেও নিজেকে ভিক্টিম বা ভুক্তভোগী হিসেবে তুলে ধরেছেন মমতা। বিজেপিকে আগ্রাসী সেনা রূপে দেখিয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, বাইরে থেকে এসে বিজেপি যেকোনো মূল্যে রাজ্য জয় করতে চায়। আট দফার ভোটের ময়দানে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের মধ্য দিয়ে অবশ্য এমন অভিযোগের যৌক্তিকতাও মিলেছে। শেষ সময়ে এসে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশের মমতার নিকটতম কর্মকর্তাদের বদলিও একই বার্তা দিয়েছে। মমতা সিআরপিএফ বা সিআইএসএফের সমালোচনা করে সময় নষ্ট করেননি। তিনি শুরু থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা অমিত শাহকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। বলে এসেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাঁকে হারাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। শিতলকুচিতে সিআইএসএফের হাতে তৃণমূলের চার কর্মী নিহতের ঘটনাও একই বার্তা দিয়েছে।
অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহার করে তৃণমূল নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও বাড়িঘরে তল্লাশির কৌশলটি ভালোমতো আরোপ করেছে। এতেও হিতে বিপরীত হয়েছে। তৃণমূলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা ও মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দিয়ে চড়াও হতে চেয়েছে। অভিষেকের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে। এ ছাড়া মদন মিত্রের মতো নেতাদের একইভাবে আক্রমণ করা হয়েছে।
মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে বিজেপি শারদ পাওয়ারের বিরুদ্ধে একই পন্থা অবলম্বন করেছিল এবং রীতিমতো হিতে বিপরীত হয়েছিল। ঝানু রাজনীতিবিদ হিসেবে মমতা এ ক্ষেত্রে ভিক্টিম কার্ড খেলে ভোটারদের সহানুভূতি অর্জন করেছেন।
অন্যদিকে, বিজেপির অন্দরের বিশ্লেষণ হিসেবে যে পাঁচ কারণের কথা জানিয়েছে আনন্দবাজার :
২. মুখের অভাব। রাজ্য বিজেপি নেতারা প্রচার পর্বে অনেক পরিশ্রম করলেও কোনো মুখ তুলে ধরতে পারেননি। এই সিদ্ধান্ত ছিল বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরই। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা বার বার বাংলার ‘ভূমিপুত্র’ই মুখ্যমন্ত্রী হবেন বলে জানালেও আলাদা করে কারও নাম বলেননি। অন্যদিকে, তৃণমূলের মুখ ছিলেন ১০ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকা লড়াকু নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাংলার মেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
৩. বাংলার কোনো নেতাকে মুখ হিসেবে তুলে না ধরার জন্য নীলবাড়ির লড়াইয়ে বড় বেশি নির্ভরতা ছিল কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপরে। আর সেই নির্ভরতাকে ‘বহিরাগত’ তকমা দিয়ে আক্রমণ শানিয়েছে তৃণমূল। বিজেপি প্রাথমিকভাবে মনে করছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ তৃণমূলের এই আক্রমণকেই সমর্থন দিয়েছে বাংলার মানুষ।
৪. রাজ্য বিজেপি আরও একটি কারণকে গুরুত্ব দিচ্ছে। দলের উচ্চাভিলাষী বক্তব্য, ২০১৬ সালে বিজেপি রাজ্যে মাত্র তিনটি আসনে জিতেছিল। সেখান থেকে একেবারে ক্ষমতায় আসার যে লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল তা দলের অভিজ্ঞতার তুলনায় অনেকটাই বেশি। লোকসভা নির্বাচনের ফলকে বিধানসভা ভোটের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য দেওয়া ঠিক হয়নি। তাই এই হারকে বড় মনে হচ্ছে।
৫. ধর্মীয় মেরুকরণকে হাতিয়ার করে নীলবাড়ির লড়াইয়ে ফায়দা তুলতে চেয়েছিল বিজেপি। প্রচার পর্বে অনেক ক্ষেত্রেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোষণের অভিযোগ তুলতে কড়া ভাষা প্রয়োগ করেছেন নেতারা। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছে এর ফলে মুসলিম ভোট এককাট্টা হলেও হিন্দু ভোটের সিংহ ভাগ ঝুলিতে টানা যায়নি।
অন্যদিকে, আশুতোষ তাঁর লেখায় জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের ২৭ শতাংশ ভোট মুসলিম। অনেকে এ সংখ্যা ৩০ শতাংশ বলেন। এজন্য মমতাকে মুসলিম নেত্রী হিসেবে আখ্যা দিয়েও তেমন ফল মেলেনি। তৃণমূল নেত্রীকে বেগম মমতা বলতে শুরু করেন বিজেপি নেতারা। অন্যদিকে নির্বাচনি প্রচারণায় চণ্ডীপাঠ করে হিন্দুদের আস্থা ধরে রাখেন মমতা বন্দোপাধ্যায়।
৬. বিজেপিতে ‘আদি ও নব্য’ বিবাদ অনেক দিনের। গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই এই অভিযোগ নিয়ে দলের মধ্যে অনেক গোলোযোগ হয়েছে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের আগে আগে তৃণমূল থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের প্রাধান্য দেওয়া দলের কর্মী, সমর্থক এবং ভোটটাররা ভালো চোখে নেয়নি বলেই মনে করছে বিজেপি। একই সঙ্গে রাজ্য নেতাদের বক্তব্য, রাজ্যের সর্বত্রই প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে অনেক ভুল ছিল।