নির্বাচন কমিশনের হারিয়ে যাওয়া একটি ল্যাপটপসহ কয়েকটি ল্যাপটপ দিয়ে রোহিঙ্গাসহ ৫৫ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের এক পরিচালকসহ চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বুধবার দুপুরে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ এর উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন বাদী হয়ে এই মামলা করেন।
তবে, দুপুরে মামলা দায়েরের পর বিকালে মামলার বাদীকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলির আদেশ দেয় দুদক। জানা গেছে, দুদকের ২১ জনের বদলি আদেশে শরীফ উদ্দিনের নাম আছে।
এ বিষয়ে দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, শরীফ উদ্দিনের এই বদলি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের এনআইডিতে অন্তর্ভুক্তিকরণ ও জন্মসনদ পাওয়া নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মচারীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা আরও কয়েকটি মামলার বাদী শরীফ উদ্দিন।
আজ দায়েরকৃত মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন, নির্বাচন কমিশনের পরিচালক খোরশেদ আলম, কক্সবাজারের রামু উপজেলা নির্বাচন অফিসার মাহফুজুল ইসলাম, পটিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসের অফিস সহকারী রাসেল বড়ুয়া ও চট্টগ্রাম পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসের সাবেক টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মো. মোস্তফা ফারুক।
খোরশেদ আলম চট্টগ্রামে সাবেক সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার হিসাবেও দায়িত্বপালন করেছেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা একে অন্যের সহায়তায় নিজে অন্যায়ভাবে লাভবান হয়ে এবং অন্যকে অন্যায়ভাবে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক এবং অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করে চট্টগ্রাম জেলার ভোটার তালিকা প্রণয়নে ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ আত্মসাতপূর্বক সেই ল্যাপটপসহ কয়েকটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে রোহিঙ্গাসহ ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকাভুক্ত করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
মামলার বাদী শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের হারিয়ে যাওয়া একটি ল্যাপটপসহ কয়েকটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে ২০১৫ সালে থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অবৈধভাবে ৫৫ হাজারের বেশি লোককে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
‘এই ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা বাসিন্দারাও আছেন’, বলেন তিনি।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আসামি রাসেল বড়ুয়া ২০১৫ সালের ২১ অক্টোবর ‘হারিয়ে যাওয়া সেই ল্যাপটপ’সহ বিভিন্ন সরঞ্জাম চালানের মাধ্যমে আসামি মোস্তফা ফারুকের কাছে হস্তান্তর করেন। ওইদিনই মোস্তফা ফারুক প্রাপ্তি স্বীকারপত্রে স্বাক্ষরপূর্বক ল্যাপটপসহ চালানে যাবতীয় সরঞ্জাম গ্রহণ করে মিরসরাই উপজেলা নির্বাচন অফিসারের কার্যালয়ে নিয়ে যান। মিরসরাইয়ের সাবেক উপজেলা নির্বাচন অফিসার তোফায়েল আহম্মদ তদন্তকারীদের জানান, ২০১৫ সালে কাজ শেষে সেগুলো ফেরত দেন তিনি। পরে তৎকালীন উচ্চমান সহকারী আসামি মাহফুজুল ইসলাম সেই ল্যাপটপ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ল্যাপটপটি বিভিন্ন উপজেলায় ব্যবহার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হলেও সর্বশেষ অবস্থান তদন্তকালে নিশ্চিত করতে পারেনি চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
কিন্তু, দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও মাহফুজুল ইসলাম ও রাসেল বড়ুয়া ল্যাপটপটি না পাওয়ার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাননি এবং তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা খোরশেদ আলমও সেটি উদ্ধারের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।
পরে দুদক অনুসন্ধান করে জানতে পারে, আত্মসাতকৃত ল্যাপটপসহ আরও কয়েকটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে রোহিঙ্গাসহ মোট ৫৫ হাজার ৩১০ জনকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের আওতাধীন সাতটি ল্যাপটপ হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে রাঙ্গামাটি সদর থানায় ২০০৯ সালে একটি ও চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানায় ২০১২ সালে আরও একটিসহ মোট দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এ ছাড়া, কাপ্তাই থানায় ২০১৪ সালে আরেকটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।
কিন্তু, হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপের বিষয়ে কেউই আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
মামলায় আরও বলা হয়েছে, কক্সবাজারের টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে রোহিঙ্গা ডাকাত নুর আলমের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশি ভোটার আইডি কার্ড পাওয়ার ঘটনা ও ৪৬টি ভুয়া এনআইডির ঘটনা তদন্ত করতে খোরশেদ আলমকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু, সেই ঘটনা তদন্তের সময় তদন্ত কমিটি উল্লেখিত ল্যাপটপটির বিষয় এড়িয়ে গেছেন এবং এ বিষয়ে কোনো কর্মকর্তা কর্মচারীকে দায়ী বা কোনো মন্তব্য করা হয়নি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, আসামি খোরশেদ আলম চট্টগ্রামে সেই ঘটনাকালে দায়িত্বে থাকার কারণে নিজেকে এবং অন্য আসামিদের অপরাধের দায় থেকে বাঁচানোর অপচেষ্টা করেছেন এবং গায়েব হওয়া ল্যাপটপটির বিষয়ে থানায় মামলা বা সাধারণ ডায়েরি না করে কিংবা কর্তৃপক্ষের নজরে না এনে অপরাধ সংগঠনে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন।
বদলি আদেশ
আজ বিকালে দুদকের পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলামের স্বাক্ষর করা এক বদলি আদেশে বলা হয়েছে, পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের নিম্নোক্ত কর্মকর্তাগণকে তাদের নামের পাশে বর্ণীত স্থানে বদলি বা সংযুক্ত করা হলো। বদলি হওয়া ২১ জন উপ-সহকারী পরিচালকের মধ্যে ১৭ নম্বরে আছেন মামলার বাদী শরীফ উদ্দিন। তাকে পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। আদেশে বদলিকৃত কর্মকর্তারা আগামী ১ জুলাইয়ের মধ্যে কর্মস্থল থেকে অবমুক্ত হবেন, অন্যথায় সেই তারিখের পর তাৎক্ষণিক অবমুক্ত হবেন।
এ বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যাদের কর্মক্ষেত্রে আড়াই থেকে তিন বছরের ঊর্ধ্বে অতিবাহিত হয়েছে, তাদের বদলি করা হয়েছে। এটি স্বাভাবিক বদলি। কাজের গতি আনতেই এই রুটিন ওয়ার্ক, সে ভালো কাজ করছে।’
‘কমিশন অনুমোদন না দিলে সে তো মামলা করতে পারতো না। অনুমোদন পাওয়ার পরই সে মামলা করেছে। মামলা করার কারণেই যে সে বদলি হয়েছে, এটা সঠিক নয়। এটা পুরোপুরি আলাদা বিষয়’, যোগ করেন তিনি।
এদিকে, রোহিঙ্গা দম্পতিকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করায় নির্বাচন কমিশনের তিন কর্মচারী ও দুই রোহিঙ্গাসহ সাত জনের বিরুদ্ধে আলাদা একটি মামলা করেছে দুদক।
সংস্থাটির উপ-পরিচালক সুভাষ চন্দ্র দত্ত বাদী হয়ে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এ মামলা করেন।
মামলায় নির্বাচন কমিশনের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন, নূর আহম্মদ, সাবেক ডেটা এন্ট্রি অপারেটর নঈম উদ্দিন, ওবাইদুল্লাহ, শামসুর রহমান, রোহিঙ্গা ফয়াজ উল্লাহ ও তার স্ত্রী মাহমুদা খাতুনকে আসামি করা হয়েছে।