ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। আজ শুক্রবার বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়। স্থানীয় সময় শুক্রবার প্রথম প্রহরে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। রাত ২টায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ১১ দিনের সহিংসতার অবসান ঘটল।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে এবারের সহিংসতায় ২৪০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২৩২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০০ জনের বেশি নারী ও শিশু। আহত হয়েছে ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি।
ইসরায়েলের দাবি, গাজায় তাদের হামলায় কমপক্ষে ১৫০ জন ‘সন্ত্রাসী’ নিহত হয়েছে। অবশ্য ইসরায়েলি হামলায় সংগঠনের সদস্যদের প্রাণহানির বিষয়ে হামাস কোনো তথ্য দেয়নি। ইসরায়েলের ভাষ্য, সংঘাতে গাজা থেকে প্রায় ৪ হাজার রকেট ছোড়া হয়েছে। রকেটে ২ শিশুসহ অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছে। আর আহত হয়েছে অন্তত ৩৩০ জন।
সংঘাতে ইসরায়েল ও হামাস উভয় পক্ষ নিজেদের জয় দাবি করেছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরপরই গাজার রাস্তায় নেমে আসেন ফিলিস্তিনিরা। তাঁরা স্বস্তি ও উল্লাস প্রকাশ করেন।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেছেন, অগ্রগতির ক্ষেত্রে এই যুদ্ধবিরতি প্রকৃত সুযোগ এনেছে।
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের রাজনৈতিক নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভার বৈঠকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার ব্যাপারে ঘোষণা আসে। তারপরই হোয়াইট হাউসে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেন বাইডেন।
ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার বিবৃতিতে বলা হয়, মিসরের দেওয়া সমঝোতা প্রস্তাব অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতিতে তারা সম্মত। তবে এই যুদ্ধবিরতি হবে ‘দ্বিপক্ষীয় ও শর্তহীন’।
তার আগে হামাসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছিলেন, তাঁরা দু-এক দিনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হতে পারে বলে মনে করছেন।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের চলমান সংঘাতের সূত্রপাত মূলত গত ১৩ এপ্রিল। পবিত্র রমজান মাসের প্রথম রাতে জেরুজালেমে দামেস্ক গেট বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনায় সেদিন পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি পুলিশের সঙ্গে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। এরপর থেকেই উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এ উত্তেজনা চরমে পৌঁছায় পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জারাহ এলাকায় কয়েকটি ফিলিস্তিন পরিবারকে উৎখাতের মাধ্যমে।
২ মে শেখ জারাহ এলাকায় ইসরায়েলি পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়। উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ জারাহ এলাকায় ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে উৎখাতের বিষয়ে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট ৯ মে শুনানি পিছিয়ে দেন। তবে এতে উত্তেজনা থামেনি। ১০ মে পবিত্র আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এরপর হামাস রকেট হামলা চালালে পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন থেকে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। হামাসও পাল্টা জবাব দিতে থাকে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে এবারের সংঘাতকে বলা হচ্ছে ২০১৪ সালের পর সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাত। ২০১৪ সালের ওই সংঘাতে ২ হাজার ২৫১ ফিলিস্তিনি নিহত হন। ইসরায়েলের পক্ষে প্রাণহানি ছিল ৭৪, যাঁদের অধিকাংশই সেনাসদস্য।
এদিকে
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো এরন ডেভিড মিলার ভ্যানিটি ফেয়ার’র এবিগেইল ট্রেসিকে সে কথাই বলেছেন। মিলারের রয়েছে দীর্ঘদিনের পররাষ্ট্র বিষয়ক পর্যালোচনা ও মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘ দিন কূটনীতিক থাকার অভিজ্ঞতা।
এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলনীতিতে ওয়াশিংটনে ইসরায়েল লবির প্রভাব সুস্পষ্ট। কিন্তু, বিভিন্ন সূত্রই বলছে যে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপলব্ধি করছেন যে ইসরায়েলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের প্রথাসিদ্ধ নীতি এখন আর বহাল রাখা সম্ভব নয়। এটা একার্থে প্রজন্মগত পার্থক্য বলে একজন কূটনীতিক এবিগেইল ট্রেসিকে বলেছেন। তার সামান্য ইঙ্গিত হচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযানের প্রতি সমর্থন আর বেশি সময় অব্যাহত রাখতে পারবে না। এটা নিঃসন্দেহে হতাশার জন্ম দেয় যে, বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা আগের যেকোনো প্রশাসনের চেয়ে ভিন্ন কিছু হলো না। কিন্তু, এটা ঠিক যে, হঠাৎ করে নাটকীয়ভাবে এই নীতি বদলাবে তা আশা করাও অবাস্তব। এই বিষয়ে ভবিষ্যতে কী হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এই যুদ্ধবিরতি সেই সুযোগ তৈরি করবে কি না সেটা আমরা লক্ষ্য করবো। ইসরায়েলের নেতারা এই পরিবর্তন নিশ্চয় উপলব্ধি করছেন, তারা কী করবেন সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে এই পরিবর্তনের ইঙ্গিত যেমন ইতিবাচক তেমনি মনে রাখা দরকার যে, গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে— সেটা ফিলিস্তিনিদের জন্যে আশার বিষয় নয়।
অনেকেই অভিযোগ করবেন যে, এই দেশগুলো আগেও কেবল কথার কথা হিসেবেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বলতো। বাস্তবতা হচ্ছে এখন সেটাও হ্রাস পাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত এক সময় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সবচেয়ে বেশি সরব ছিল। বেশ কিছু বছর ধরে ভারতের সেই অবস্থান নেই, নরেন্দ্র মোদির সরকার খোলামেলা ভাবেই ইসরায়েলের পক্ষে— আদর্শিক কারণে এবং রিয়েলিস্ট পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে।
ফিলিস্তিনিরা এই পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করে কোন পথে পা বাড়ান সেটাও নির্ধারণ করবে আগামীতে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে কী আছে।