বিশেষজ্ঞদের মতেভাইরাসটিতে ৫টি জিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে আগের চেয়ে ওআরএফ১এবি জিনের আধিক্য লক্ষণীয়।
দেশে করোনাভাইরাসের নমুনায় শক্তিশালী জিনের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। ফলে করোনাভাইরাস আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এটি মানবদেহে আরও বেশি সংক্রমণ ঘটানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। এতে করোনা আক্রান্তদের মৃত্যু হার আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত ৩ সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ল্যাবে নমুনা পরীক্ষায় এ জিনটির উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। ওআরএফ১এবি (ওপেন রিডিং ফ্রেম ১ এবি) জিন ভাইরাসটির শক্তিমত্তা প্রকাশ করছে। এটি জিনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে শক্তি বাড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে ইতোমধ্যে মৃত্যুর হার বৃদ্ধির ওপর এটি প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। দেশে করোনায় মৃত্যুর হার আগের চেয়ে বেড়েছে।
চলতি মে মাসে প্রতিদিনই মৃতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে করোনাভাইরাসের জিনগত বৈশিষ্ট্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে বলে তারা উল্লেখ করেন।
দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা হয় এমন বেশকিছু ল্যাবে কর্মরত মাইক্রোবায়োলজিস্ট (অনুপ্রাণবিদ) ও ভাইরোলজিস্টেরা(ভাইরাসবিদ)
জানান, পিসিআর (পলিমার চেইন রিঅ্যাএকশন) ল্যাবে যখন সংগৃহীত নমুনার পিসি (পজিটিভ কন্ট্রোল) পরীক্ষা করেন, তখন আগে ভাইরাসটির এন জিন বেশি দেখা যেত।
তবে গত প্রায় তিন সপ্তাহ বা তারও কিছু বেশি সময় ধরে ওআরএফ১এবি জিন বেশি দেখা যাচ্ছে। তারা বলছেন, ওআরএফ১এবি জিনে আধিক্য প্রাথমিক ভাবে ভাইরাসটির আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার প্রমাণ করছে।
অর্থাৎ ভাইরাসটি মানবদেহে আরও বেশি মাত্রায় সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম হয়ে উঠেছে। যার ফলে আক্রান্তদের মধ্যে জটিলতা ও রোগের তীব্রতাসহ মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ৫টি জিন পাওয়া গেছে। এগুলো হল- এন জিন, এস জিন, ই জিন, আরডিআরএফ জিন এবং ওআরএফ১এবি জিন।
এই পাঁচ ধরনের জিনের মধ্যে ওআরএফ১এবি জিন ভাইরাসটির ভিরুলেন্স (রোগ উৎপাদন করার সক্ষমতা) প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘ডেজিগনেটেড রেফারেন্স ইন্সটিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস (ডিআরআইসিএম)’ করোনাভাইরাসের জিনম সিকুয়েন্স বা জীবন রহস্য উন্মোচন করেছে।
যা বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরীক্ষাধীন। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ড. মালা খান যুগান্তরকে বলেন, তারা ভাইরাসটির জীবন রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে পাঁচটি জিনের অস্তিত্ব পেয়েছেন।
এর মধ্যে ওআরএফ১এবি জিনের আধিক্য লক্ষ্য করেছেন। একই ধরনের মন্তব্য করেন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসম) ভাইরোলজিস্ট ডা. জামালউদ্দিন।
তিনি বলেন, তারা যখন প্রথম পিসিআর করা শুরু করেন, তখন ভাইরাসটির এন জিন বেশি দেখতে পেতেন। তবে বর্তমানে ওআরএফ১এবি জিনটিও বেশি দেখতে পাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে ভাইরাসটির যে পর্যবেক্ষণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার ওপর আরও বিস্তারিত গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন। তাহলে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ওই দিন থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশে এ রোগে মৃত্যু হয়েছিল ৫ জনের।
পরবর্তী ১ মাসে অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৮, এবং পরবর্তী ১ মাসে অর্থাৎ ৩০ মে পর্যন্ত ৬১০ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
অর্থাৎ ১ মাসে ৪৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ তথ্যই প্রমাণ করে, প্রথম ২ মাসের তুলনায় বিগত ৩০ দিন মৃত্যু হার বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রর তথ্য অনুযায়ী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। একদিনে মৃত্যুর দিক দিয়ে এটাই এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যা।
এমাসেই আর একদিন ২৮ জনের মৃত্যু হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত ২৮ জনের মধ্যে পুরুষ ২৫ জন ও নারী ৩ জন। শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বয়স বিভাজনে ৩১-৪০ বছরের মধ্যে ৪ জন, ৪১-৫০ বছরের মধ্যে ৪ জন, ৫১-৬০ বছরের মধ্যে ৯ জন, ৬১-৭০ বছরের মধ্যে ৬ জন, ৭১-৮০ বছরের মধ্যে ৩ জন এবং ৮১-৯০ বছরের মধ্যে ২ জন মৃত্যুবরণ করেছেন।
বয়স বিভাজনে এ পর্যন্ত যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের ১ থেকে ১০ বছরের মধ্যে মৃত্যু হার ২ শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে মৃত্যু হার ০ শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে মৃত্যু হার ৩ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে মৃত্যু হার ৭ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে মৃত্যু হার ১৯ শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে মৃত্যু হার ২৭ শতাংশ এবং ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে মৃত্যু হার ৪২ শতাংশ।
সব মিলিয়ে দেশে করোনা সংক্রমিত হয়েছেন ৪৪ হাজার ৬০৮ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ৯ হাজার ৩৭৫ জন সুস্থ হয়েছেন। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৫৪টি নমুনা। দেশে বর্তমানে ৫০টি ল্যাবে (পরীক্ষাগার) করোনা পরীক্ষা চলছে।
৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্তের ঘোষণা আসে। আর ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে